মাত্র ৩০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন দুই বন্ধু মো. মাসুদুজ্জামান খান ও রাশেদ নাসের। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর এক কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ পেয়েছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশত করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি করেছে আড়াই শতাধিক গাড়ি। এ ছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্প্রতি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনও শুরু করেছে তারা।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে বেশ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন দুই তরুণ। এক যুগের বেশি সময় চাকরি শেষে ব্যবসায় নামেন তাঁরা। নিজেদের জমানো পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গাড়ির রূপান্তরের প্রতিষ্ঠান অগ্রণী অটোমোবাইলস। মূলত গাড়ির মূল কাঠামো ও বিভিন্ন ধরনের উপরিকাঠামো তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।
মাত্র ৩০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গত বছর এক কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ পেয়েছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশত করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি করেছে আড়াই শতাধিক গাড়ি। এ ছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্প্রতি বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনও শুরু করেছে তারা।
সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের নিকটবর্তী দুর্গাপুর সড়ক এলাকায় অগ্রণী অটোমোবাইলসের কারখানায় কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির দুই প্রতিষ্ঠাতা মো. মাসুদুজ্জামান খান ও রাশেদ নাসেরের সঙ্গে। তাঁরা যথাক্রমে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।
চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়
অগ্রণী অটোমোবাইলসের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাশেদ নাসের ঢাকা থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভারতের বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপণনের ওপর উচ্চশিক্ষা নিতে যান। স্নাতকোত্তর শেষে ২০০৫ সালে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে একটি শিক্ষার্থী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে দুই বছর চাকরি করেন। এরপর তৈরি পোশাকের উপকরণ প্রস্তুতকারক যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দুটি বহুজাতিক কোম্পানির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগে ১১ বছর কাজ করেছেন। পরে সেই চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামেন।
প্রতিষ্ঠানটির আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা মো. মাসুদুজ্জামান খান মালয়েশিয়ার বাইনারি ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে ২০০৫ সালে মালয়েশিয়াতেই হংকংভিত্তিক একটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে চাকরি নেন। দুই বছর পর দেশে ফিরে একটি অটোমোবাইল কোম্পানির তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে (এমআইএস) কাজ শুরু করেন। পরে এক যুগের বেশি সময় দেশের অটোমোবাইল ও খাদ্য খাতের বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রযুক্তি বিভাগে কাজ করেন তিনি।
চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় আসা প্রসঙ্গে তাঁরা দুজনেই জানালেন, ছাত্রাবস্থা থেকেই ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁদের। তবে ভালো ধারণা না থাকলে ব্যবসা করা কঠিন। এ জন্য আগে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এরপর ব্যবসায় নামেন তাঁরা।
রাশেদ ও মাসুদুজ্জামান দুজনই দীর্ঘদিনের বন্ধু। ফলে ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়েও মাঝেমধ্যেই কথা হতো তাঁদের। এরপর ২০১৯ সালে প্রথম দুই বন্ধু মিলে বায়োফ্লক মাছ চাষের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি এমব্রয়ডারি সুতা তৈরির ব্যবসায়ও যুক্ত ছিলেন রাশেদ। তবে করোনার কারণে ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েন। তখন ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করেন দুজন মিলে। সেই চিন্তা থেকেই যুক্ত হন গাড়ির রূপান্তর ও সাজসজ্জার ব্যবসায়।
৩০ লাখ টাকায় শুরু
২০২১ সালের মার্চে দুই বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেন অগ্রণী অটোমোবাইলস। রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারসংলগ্ন দুর্গাপুর সড়কে তাদের নিজস্ব জায়গা ছিল। সেখানেই ১৪ কাঠা জায়গায় কোম্পানির কারখানা স্থাপন করেন। কারখানা স্থাপনে প্রাথমিক পুঁজি ছিল ৩০ লাখ টাকা। পরে এ বিনিয়োগ আরও বাড়িয়েছেন তাঁরা।
প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মাসুদুজ্জামান খান বলেন, ‘চাকরির কারণে অটোমোবাইল ও প্রযুক্তি খাতে আমার ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। পাশাপাশি রাশেদ নাসেরের ছিল বিক্রয় ও বিপণনের অভিজ্ঞতা। তাই দুজনে মিলে কিছু করলে তাতে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে—এমন ধারণা থেকেই আমাদের গাড়ির ব্যবসায় আসা।’
মাসুদুজ্জামান আরও বলেন, ‘সম্পূর্ণ তৈরি বাণিজ্যিক গাড়ি আমদানি করে দেশে এনে বিক্রি করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এ জন্য অনেকে আমদানি করা চেসিস দিয়ে স্থানীয়ভাবে অন্যান্য উপকরণ তৈরি করেন। তবে এ খাতে প্রশিক্ষিত কারিগরের অভাব রয়েছে। আমরা সেই জায়গাটি পূরণের চেষ্টা করছি। একটি গাড়ি যাতে মজবুতভাবে তৈরি ও দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগী রাখা যায়, সে জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ড মেনে তা প্রস্তুত করে দিচ্ছি আমরা।
যে ধরনের গাড়ি তৈরি হয়
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম দিকে চেসিস আমদানি করে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন যেমন, কার্গো বডি ট্রাক, ওপেন ট্রাক, ডাম্প ট্রাক ইত্যাদি তৈরি করেছে অগ্রণী অটোমোবাইলস। এখন সেই কাজের পাশাপাশি বিশেষ সুবিধার (স্পেশাল পারপাস) বিভিন্ন যান তৈরি শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেমন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য একাধিক ভ্রাম্যমাণ চক্ষু হাসপাতাল বানিয়ে দিয়েছে অগ্রণী অটোমোবাইলস। বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ এ ধরনের গাড়ি আমদানি করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। তবে অগ্রণী অটোমোবাইলস স্বল্প খরচেই ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের কাঠামো ও অন্দরসজ্জা করে দিয়েছে।
এভাবে ভ্রাম্যমাণ ডেন্টাল হাসপাতাল, মোটরসাইকেল ক্যারিয়ার, ফুড কার্ড ডেলিভারি ক্যারিয়ার, সিলিন্ডার ক্যারিয়ার, আর্কেড গেম উপকরণ ক্যারিয়ার, ক্যারাভ্যান, ইনসুলেশন ট্রলি, লাশ বহনকারী গাড়ি, ওয়েল ও মিল্ক ক্যারিয়ার ইত্যাদি গাড়ি তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া কনটেইনার দিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক হোটেল, রিসোর্ট বা ডরমিটরির কক্ষও তৈরি করছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব কনটেইনারের অভ্যন্তরে থাকছে অফিসকক্ষ, বিশ্রামকক্ষ, ওয়াশ রুমসহ বিভিন্ন সুবিধা। এ ছাড়া বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ প্রসূতি হাসপাতাল ও ডেন্টাল হাসপাতালের সুবিধা–সংবলিত বেশ কিছু গাড়ি প্রস্তুতের কার্যাদেশ রয়েছে।
অগ্রণী অটোমোবাইলসের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাশেদ নাসের বলেন, ‘গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে যেকোনো ধরনের পণ্য পরিবহন ও সেবা উপযোগী গাড়ি তৈরি করি আমরা। বর্তমানে ১৪ জন নিয়মিত কর্মী কাজ করছেন অগ্রণী অটোমোবাইলসে। এ ছাড়া কাজের চাহিদা অনুসারে অস্থায়ী ভিত্তিতেও বেশ কিছু শ্রমিক কাজ করেন।’
বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির উদ্যোগ
সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন শুরু করেছে অগ্রণী অটোমোবাইলস। প্রতিষ্ঠানটি নতুন উৎপাদিত এ গাড়ির ব্র্যান্ড নাম দিয়েছে ‘ইভোটেক’। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট, আবাসিক এলাকা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ও শিল্পকারখানার অভ্যন্তরে ব্যবহার উপযোগী করে ছোট আকারের ইভোটেক গাড়ি তৈরি করছে তারা।
দুই থেকে আট আসনের এসব গাড়িতে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছেন। গাড়িটি চালাতেও পারবেন যে কেউ। ছয় আসনের ইভোটেক গাড়ির ধারণক্ষমতা ১ টন। একবার চার্জে গাড়িটি ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এ ধরনের আমদানি করা গাড়ির তুলনায় তাঁরা ৫০ শতাংশ কম দামে ইভোটেক বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে রাশেদ নাসের বলেন, দেশে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। পরিবেশগত দিক থেকেও বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই এখন আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করা।
শুরুতে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি ও দেশীয় উপকরণ দিয়ে ছোট আকারের বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করছে অগ্রণী অটোমোবাইলস। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য, পর্যায়ক্রমে ৫০০ কেজি থেকে ২ টন ধারণক্ষমতার বড় গাড়ি তৈরি করা। এর মধ্যে থাকবে স্কুল ও স্টাফ বাসসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক যান। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মো. মাসুদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন না পাওয়া আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বর্তমানে প্রতিটি কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তাই পরিবেশবান্ধব গাড়ি উৎপাদনে সরকারি নীতিসহায়তা প্রয়োজন।’